সাগর কলা চাষ: বিস্তারিত নির্দেশিকা

সাগর কলা, যা এর মিষ্টি স্বাদ এবং নরম শাঁসের জন্য পরিচিত, বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল। এর বাণিজ্যিক চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে এটি লাভজনক একটি ফসল হতে পারে। এই আর্টিকেলে সাগর কলা চাষের আদ্যোপান্ত আলোচনা করা হলো।
সাগর কলার পরিচিতি ও জাত
সাগর কলা (Musa acuminata) মূলত "গ্র্যান্ড নাইন" (Grand Nain) জাতের একটি উপ-জাত। এটি একটি টিস্যু কালচার জাত এবং এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি উচ্চ ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন। এই কলার গাছ মাঝারি আকারের হয় এবং ফলন তুলনামূলকভাবে দ্রুত হয়। সাগর কলা কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
সাগর কলা চাষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ
সাগর কলা উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু পছন্দ করে। এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে দেওয়া হলো:
* জলবায়ু: ২০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সাগর কলা চাষের জন্য আদর্শ। উচ্চ আর্দ্রতা (৭০-৮০%) গাছের বৃদ্ধি ও ফলনে সহায়তা করে। তীব্র ঠান্ডা বা অতিরিক্ত গরম সাগর কলার ফলন ও গুণগত মানকে প্রভাবিত করতে পারে।
* মাটি: সুনিষ্কাশিত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি সাগর কলা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। মাটির pH মান ৬.০ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে থাকা ভালো। এঁটেল মাটি এড়িয়ে চলা উচিত কারণ এতে জল জমে গাছের ক্ষতি হতে পারে।
* সূর্যালোক: সাগর কলা গাছের জন্য পর্যাপ্ত সূর্যালোক প্রয়োজন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা সরাসরি সূর্যালোক পেলে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং ফলনও বেশি হয়।
চারা রোপণ পদ্ধতি
সাগর কলা চাষে টিস্যু কালচার পদ্ধতির চারা ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো। এতে গাছের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে এবং ফলনও নিশ্চিত হয়।
* চারা সংগ্রহ: বিশ্বস্ত উৎস থেকে রোগমুক্ত ও সুস্থ টিস্যু কালচারের চারা সংগ্রহ করুন।
* জমি তৈরি: জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে করে নিন। জমিতে পর্যাপ্ত জৈব সার (যেমন গোবর সার বা কম্পোস্ট) প্রয়োগ করুন।
* গর্ত তৈরি: চারা রোপণের জন্য ৬০ সেমি. x ৬০ সেমি. x ৬০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করুন। প্রতিটি গর্তের মাঝে ২-২.৫ মিটার দূরত্ব রাখুন এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩-৩.৫ মিটার রাখুন।
* চারা রোপণ: গর্তের নিচে কিছু জৈব সার ও টিএসপি সার মিশিয়ে দিন। এরপর গর্তের মাঝখানে চারাটি বসিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিন এবং হালকা চাপ দিন। চারা রোপণের পরপরই হালকা সেচ দিন।
সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা
সাগর কলার ভালো ফলনের জন্য সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ এবং নিয়মিত পরিচর্যা জরুরি।
* সার প্রয়োগ:
* জৈব সার: প্রতি গাছে ১০-১৫ কেজি গোবর সার বা কম্পোস্ট জমি তৈরির সময় অথবা চারা রোপণের আগে প্রয়োগ করুন।
* রাসায়নিক সার: ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি এবং জিপসাম সার সুপারিশকৃত মাত্রায় প্রয়োগ করুন। সাধারণত, প্রতি গাছে বছরে ২৫০-৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০-২০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০-৩০০ গ্রাম এমওপি এবং ৫০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োজন হয়। সার কয়েকটি কিস্তিতে প্রয়োগ করা ভালো। বিশেষ করে চারা রোপণের ১-২ মাস পর থেকে ফুল আসা পর্যন্ত।
* সেচ: সাগর কলা গাছের জন্য পর্যাপ্ত জল অপরিহার্য। শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত সেচ দেওয়া প্রয়োজন। বৃষ্টির উপর নির্ভর না করে মাটিতে আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে। ফল আসার পর এবং ফলের বৃদ্ধির সময় সেচ আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
* আগাছা দমন: নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করুন। আগাছা গাছের পুষ্টি শোষণ করে এবং ফলন কমিয়ে দেয়।
* বাছাইকরণ (Dewatering): কলার মোচা বের হওয়ার পর অতিরিক্ত মোচা এবং অপ্রয়োজনীয় পাতা কেটে ফেলুন। এতে পুষ্টি ফলের দিকে প্রবাহিত হয়।
* ঠেকনা দেওয়া: ফলন বেশি হলে এবং কলার ছড়ি বড় হলে গাছ হেলে যেতে পারে। এক্ষেত্রে বাঁশ বা অন্য কোনো শক্ত কাঠি দিয়ে ঠেকনা দিন যাতে গাছ ভেঙে না যায়।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
সাগর কলা গাছে বিভিন্ন রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। সঠিক সময়ে এদের দমন করতে পারলে ফসলের ক্ষতি কমানো যায়।
* পানামা রোগ (Panama Disease): এটি ছত্রাকজনিত রোগ যা গাছের পাতা হলুদ করে এবং শেষ পর্যন্ত গাছকে মেরে ফেলে। এই রোগের কোনো কার্যকর প্রতিকার নেই, তাই রোগমুক্ত চারা ব্যবহার এবং রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলা জরুরি।
* সিগাটোকা রোগ (Sigatoka Disease): এটিও ছত্রাকজনিত রোগ। পাতায় বাদামী দাগ দেখা যায়। রোগের তীব্রতা বেশি হলে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
* কলার বিটল (Banana Weevil): এই পোকা কলার কাণ্ডে আক্রমণ করে। কীটনাশক ব্যবহার করে এর দমন করা যায়।
* অন্যান্য: মেলি বাগ, স্কেল পোকা ইত্যাদিও কলা গাছে আক্রমণ করতে পারে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
ফল সংগ্রহ ও ফলন
সাগর কলা রোপণের ৯-১২ মাসের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়।
* ফল সংগ্রহের সময়: যখন কলার ছড়িগুলো সম্পূর্ণ আকার ধারণ করে এবং কিনারাগুলি গোলাকার হতে শুরু করে, তখন ফল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। ফলগুলো সম্পূর্ণ পাকতে দেওয়া উচিত নয়, কারণ এতে পরিবহনে সমস্যা হতে পারে।
* ফলন: সঠিক পরিচর্যা এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে প্রতি বিঘা জমিতে ১০০০০-১৫০০০ কেজি বা তার
ও বেশি সাগর কলা উৎপাদন করা সম্ভব।
What's Your Reaction?






