পেঁপে চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত
পেঁপে একটি পুষ্টিকর এবং জনপ্রিয় ফল ও সবজি। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। নিচে পেঁপে চাষের বিস্তারিত পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:

১. উপযুক্ত মাটি ও জলবায়ু
* মাটি: জল নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি পেঁপে চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। মাটির পিএইচ (pH) ৬.৫ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে হলে ভালো হয়। পেঁপে গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না, তাই উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে।
* জলবায়ু: পেঁপে চাষের জন্য ৩৮-৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উপযুক্ত। তবে ১০ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও গাছের বৃদ্ধির জন্য ভালো। সারা বছর পেঁপে চাষ করা গেলেও, বীজ বপনের জন্য আশ্বিন-পৌষ মাস (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) এবং চারা রোপণের জন্য মাঘ-ফাল্গুন মাস (জানুয়ারি-মার্চ) সবচেয়ে উপযুক্ত।
২. জাত নির্বাচন
বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের পেঁপে চাষ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু জাত হলো:
* দেশি জাত: ওয়াশিংটন, কোয়েম্বাটুর-১, কোয়েম্বাটুর-২, কুর্গ হানিডিউ, সোলো সানরাইজ, শাহী পেঁপে (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত)।
* হাইব্রিড জাত: পুসা ডোয়ার্ফ, পুসা নানহা, পুসা ম্যাজেস্টিক, পুসা রাসেল, রেড লেডি, সুইট লেডি, গোল্ডেন লেডি, কমলা সুন্দরী।
৩. জমি তৈরি ও চারা রোপণ
* জমি তৈরি: জমিকে কয়েকবার ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য বেড পদ্ধতি অবলম্বন করা ভালো। বেড থেকে বেডের মাঝে ৩০ সেমি চওড়া ও ২০ সেমি গভীর নালা রাখতে হবে। প্রতিটি বেড নালাসহ ২ মিটার চওড়া হবে।
* মাদা তৈরি: চারা রোপণের ১৫-২০ দিন আগে ৪৫ সেমি লম্বা, ৪৫ সেমি চওড়া ও ৪৫ সেমি গভীর গর্ত বা মাদা তৈরি করতে হবে। গর্তের উপরের মাটি একপাশে এবং নিচের মাটি অন্যপাশে রাখতে হবে।
* চারা উৎপাদন: পলিব্যাগে চারা তৈরি করলে রোপণের পর চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ৫x৪ ইঞ্চি আকারের ব্যাগে সমান পরিমাণে বালি, মাটি ও পচা গোবরের মিশ্রণ ভর্তি করে ব্যাগের তলায় ২-৩টি ছিদ্র করতে হবে। এরপর প্রতিটি পলিব্যাগে ১-২টি বীজ বপন করতে হবে। বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর চারা গজায় এবং ৪০-৫০ দিন পর জমিতে রোপণের উপযোগী হয়।
* চারা রোপণ: প্রতি গর্তে ২-৩টি চারা রোপণ করতে হবে। চারা থেকে চারার দূরত্ব ১.৮ থেকে ২ মিটার হওয়া উচিত। পরাগায়ণের সুবিধার জন্য বাগানের মোট গাছের শতকরা ১০টি পুরুষ গাছ রাখা দরকার।
৪. সার প্রয়োগ পদ্ধতি
চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে প্রতিটি গর্তে নিম্নলিখিত সারগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে:
* গোবর সার: ১৫ কেজি
* টিএসপি: ৫০০ গ্রাম
* জিপসাম: ২৫০ গ্রাম
* জিংক সালফেট: ২০ গ্রাম
* বোরিক এসিড: ২০ গ্রাম
পরবর্তী সার প্রয়োগ:
* চারা রোপণের ১ মাস পর থেকে প্রতি মাসে একবার ইউরিয়া ও এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
* প্রথম দিকে প্রতিটি গাছে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম এমওপি প্রয়োগ করতে হবে।
* গাছে ফুল এলে এই মাত্রা দ্বিগুণ করতে হবে।
* সাধারণত, প্রতিটি গাছে বছরে ২০০-২৫০ গ্রাম নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম প্রয়োগ করা হয়।
৫. পরিচর্যা
* আগাছা দমন: পেঁপে চাষের জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে।
* সেচ: পেঁপের ফলন ও আকার সেচের উপর নির্ভর করে। শীতকালে ১০-১২ দিন পর এবং গ্রীষ্মকালে ৬-৭ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।
* অতিরিক্ত চারা অপসারণ: চারা লাগানোর ৪-৫ মাস পরে ফুল এলে প্রতিটি গর্তে একটি করে সবল স্ত্রী গাছ রেখে বাকি গাছগুলো তুলে ফেলতে হবে।
* ঠেস দেওয়া: গাছ যাতে ঝড়ে না ভাঙে, তার জন্য বাঁশের খুঁটি দিয়ে গাছ বেঁধে দিতে হবে।
৬. রোগ ও পোকামাকড় দমন
পেঁপে গাছে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। এর মধ্যে কিছু প্রধান রোগ ও তাদের দমন পদ্ধতি নিচে দেওয়া হলো:
রোগ
* ড্যাম্পিং অফ (ঢলে পড়া রোগ): এই রোগে চারা গাছ মারা যায় এবং বর্ষা মৌসুমে কান্ড পচা রোগও হয়।
* প্রতিকার:
* গাছের গোড়ায় পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা রাখুন।
* বীজতলার মাটি ৫% ফরমালডিহাইড দ্বারা জীবাণুমুক্ত করুন।
* রোগাক্রান্ত চারা গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলুন।
* রিডোমিল এমজেড-৭২ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর গাছের গোড়ার চারপাশের মাটিতে প্রয়োগ করুন।
* ভাইরাসজনিত পাতা কুচকানো রোগ: এ রোগে গাছের পাতা কুঁচকে যায়, কোঁকড়ানো হয় এবং গাছের বৃদ্ধি থেমে যায়।
* প্রতিকার:
* ক্ষেত থেকে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলুন।
* ভাইরাসমুক্ত বীজ বা চারা ব্যবহার করুন।
* রোগের বাহক জাব পোকা ও সাদা মাছি দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড ১ মিলি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
* মোজাইক রোগ: জিংকের অভাবে মোজাইকের মতো লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
* প্রতিকার: জিংকের ঘাটতি দেখা দিলে প্রতিটি গাছের গোড়ায় ৫-১০ গ্রাম জিংক প্রয়োগ করুন এবং ০.২% জিংক পাতার উপর স্প্রে করুন।
পোকামাকড়
* মিলিবাগ বা ছাতরা পোকা: এরা পাতা ও ডালের রস চুষে নেয়, ফলে গাছ দুর্বল হয়। পোকার আক্রমণে পাতা, ফল ও ডালে সাদা তুলার মতো দেখা যায়।
* প্রতিকার:
* আক্রান্ত পাতা ও ডগা ছেঁটে ফেলুন এবং ধ্বংস করুন।
* গাছের গোড়ার মাটি থেকে ১৫-২০ সেমি উপরে স্বচ্ছ পলিথিন দ্বারা মুড়ে দিন, যাতে মিলিবাগ গাছে উঠতে না পারে।
* আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি রগর, টাফগর, সানগর বা সুমিথিয়ন ২ মিলি মিপসিন বা সপসিন মিশিয়ে স্প্রে করুন।
পেঁপে চাষ একটি লাভজনক উদ্যো
গ হতে পারে যদি সঠিক পরিকল্পনা এবং পরিচর্যা করা হয়।
What's Your Reaction?






