পেঁপে চাষ পদ্ধতি

পেঁপে একটি জনপ্রিয় এবং পুষ্টিকর ফল। এটি চাষ করা তুলনামূলকভাবে সহজ এবং দ্রুত ফলন দেয়, যা কৃষক এবং বাড়ির বাগানি উভয়ের জন্যই লাভজনক হতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়া পেঁপে চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। চলুন, পেঁপে চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

Jul 2, 2025 - 19:39
 0  6
পেঁপে চাষ পদ্ধতি

পেঁপে চাষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ

পেঁপে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মে।

 * মাটি: সুনিষ্কাশিত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি পেঁপে চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। মাটির pH ৬.০-৭.০ এর মধ্যে হলে ভালো হয়। পেঁপে জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না, তাই এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যেখানে বৃষ্টির পানি জমে না থাকে।

 * জলবায়ু: উষ্ণ তাপমাত্রা পেঁপে গাছের বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পেঁপে চাষের জন্য আদর্শ। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা অতিরিক্ত গরম উভয়ই গাছের জন্য ক্ষতিকর।

 * সূর্যালোক: পেঁপে গাছের জন্য প্রচুর সূর্যালোক প্রয়োজন। দৈনিক কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা সরাসরি সূর্যালোক পেলে ফলন ভালো হয়।

উন্নত জাত নির্বাচন

পেঁপে চাষে ভালো ফলনের জন্য উন্নত জাত নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে কিছু জনপ্রিয় ও উচ্চ ফলনশীল জাত হলো:

 * রেড লেডি (Red Lady): এটি একটি হাইব্রিড জাত। ফলন বেশি হয় এবং ফল মিষ্টি ও সুস্বাদু। এই জাতের গাছে পুরুষ ফুল হয় না, তাই প্রতিটি গাছই ফল দেয়।

 * শাহীন (Shaheen): এটিও একটি উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাত, যা দ্রুত ফলন দেয়।

 * ইসপাহানী (Ispahani): এটিও বেশ জনপ্রিয় এবং ভালো ফলন দেয়।

 * বাংলা পেঁপে (Local Papaya): স্থানীয় জাতের পেঁপেও চাষ করা হয়, তবে ফলন ও গুণগত মান হাইব্রিড জাতের তুলনায় কম হতে পারে।

বীজ কেনার সময় অবশ্যই নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে কেনা উচিত।

চারা তৈরি ও রোপণ

চারা তৈরি:

পেঁপের চারা সাধারণত বীজ থেকে তৈরি করা হয়।

 * বীজ শোধন: বীজ বোনার আগে ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করে নিলে রোগবালাইয়ের আক্রমণ কমে।

 * বীজতলা তৈরি বা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার: ছোট পলিথিন ব্যাগ বা ট্রেতে মাটি ও জৈব সারের মিশ্রণ ভরে বীজ বপন করা যেতে পারে। প্রতি ব্যাগে ২-৩টি বীজ বুনতে হয়।

 * আর্দ্রতা রক্ষা: বীজ বোনার পর হালকা পানি দিতে হবে এবং চারা গজানোর আগ পর্যন্ত মাটি ভেজা রাখতে হবে।

 * চারার যত্ন: চারা গজানোর পর দুর্বল চারাগুলো তুলে ফেলতে হবে এবং প্রতিটি ব্যাগে একটি করে সুস্থ চারা রাখতে হবে।

চারা রোপণ:

 * জমি তৈরি: জমি ভালোভাবে চাষ করে মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে। প্রতিটি চারার জন্য ১ মিটার চওড়া এবং ১ মিটার গভীর গর্ত তৈরি করতে হবে।

 * সার প্রয়োগ: প্রতি গর্তে পচা গোবর বা কম্পোস্ট সার ১০-১৫ কেজি, ইউরিয়া ২৫০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০ গ্রাম, এমওপি ২৫০ গ্রাম এবং জিপসাম ১০০ গ্রাম ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

 * রোপণ দূরত্ব: সারিতে সারিতে ২-২.৫ মিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২ মিটার রাখা ভালো। এতে গাছের পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পাবে এবং ফলন ভালো হবে।

 * রোপণের সময়: এপ্রিল থেকে জুন মাস পেঁপে চারা রোপণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তবে সঠিক সেচ ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই পেঁপে চাষ করা যায়।

 * লিঙ্গ নির্ধারণ: পেঁপে গাছের লিঙ্গ নির্ণয় করা কঠিন। তাই প্রতিটি গর্তে ৩টি করে চারা লাগানো হয়। চারা বড় হলে যখন ফুল আসে, তখন লিঙ্গ দেখে পুরুষ গাছ (যদি বেশি হয়) তুলে ফেলা হয়। সাধারণত, প্রতি ১০টি স্ত্রী গাছের জন্য ১টি পুরুষ গাছ রাখা হয় পরাগায়নের সুবিধার জন্য। তবে রেড লেডি জাতের ক্ষেত্রে পুরুষ গাছ থাকে না বলে এই সমস্যা হয় না।

পরিচর্যা

সেচ ও নিকাশ:

 * সেচ: শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত সেচ দেওয়া প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে।

 * নিকাশ: অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি দ্রুত বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, কারণ জলাবদ্ধতা পেঁপে গাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

আগাছা দমন:

জমিতে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। আগাছা গাছের পুষ্টি শোষণ করে এবং রোগবালাইয়ের আশ্রয়স্থল হতে পারে।

সার প্রয়োগ:

চারা রোপণের ১-২ মাস পর থেকে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ২-৩ মাস অন্তর ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি এবং বোরন সার গাছের গোড়া থেকে ১ মিটার দূরে রিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হয়।

রোগ ও পোকামাকড় দমন:

পেঁপে গাছে বেশ কিছু রোগ ও পোকা আক্রমণ করে।

 * মোজেক ভাইরাস (Mosaic Virus): এটি পেঁপের একটি মারাত্মক রোগ। গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় এবং হলদে হয়ে যায়। এই রোগের কোনো প্রতিকার নেই, আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলে দিতে হয়। রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার এবং জাবপোকা দমন করে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

 * পাতার দাগ (Leaf Spot): এটি ছত্রাকজনিত রোগ। উপযুক্ত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে এটি দমন করা যায়।

 * ড্যাম্পিং অফ (Damping Off): চারা অবস্থায় এই রোগ হয়। অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে চারা মরে যায়।

 * মিলিবাগ (Mealybug): এটি পেঁপের প্রধান ক্ষতিকর পোকা। আক্রমণ দেখা দিলে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।

ফল সংগ্রহ

পেঁপে গাছে সাধারণত ৩-৪ মাসের মধ্যে ফুল আসা শুরু হয় এবং ৬-৯ মাসের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। যখন পেঁপের গায়ে হলুদ আভা দেখা দেয় এবং ফল পরিপুষ্ট হয়, তখন এটি সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। ফল সাবধানে সংগ্রহ করতে হবে, যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

পেঁপে চাষে সঠিক পরিকল্পনা, উন্নত জাত নির্বাচন এবং উপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। এতে আপনি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবেন।

আপনার পেঁপে চাষ নিয়ে

 আর কোনো প্রশ্ন থাকলে, জিজ্ঞাসা করতে পারেন।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow